‘মৃত্যুই শ্রেয়’

 



$ads={1}

বাংলাদেশে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী পরাজিত হওয়ার পর জার্মানির হামবুর্গ থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক সাময়িকী ডের স্পিগেল ছবিসহ তিন কলামব্যাপী একটি প্রতিবেদন ছাপে। মর্মস্পর্শী এই প্রতিবেদনের শিরোনাম ‘মৃত্যুই শ্রেয়’। ১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত এ প্রতিবেদনে কয়েকজন পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তার নামও ছাপা হয়। সাংবাদিক ও লেখক সরাফ আহমেদ জার্মান ভাষা থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন সেই আলোচিত প্রতিবেদনটি।


আরো পড়ুন - এবারের ‘ইত্যাদি’ নেত্রকোণায়


দুই লাখ বাঙালি নারীকে ধর্ষণ করেছে পশ্চিম পাকিস্তানের দখলদারেরা। এই নারীরা এখন নিজ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন।

 

১৪ বছরের একজন বাঙালি মেয়ে সাত মাসের গর্ভবতী, তার ১১ বছর বয়সী ছোট বোনটি ধর্ষণের কারণে মারা গেছে। পশ্চিম পাকিস্তানি দখলদারদের সহায়তাকারী স্বেচ্ছাসেবী সংখ্যালঘু বিহারি রাজাকাররা দুই বোনকে গত জুলাই মাসে ঢাকার রাস্তা থেকে প্রকাশ্যে অপহরণ করে টেনেহেঁচড়ে তাদের এলাকা মোহম্মদপুরে নিয়ে যায়। মেয়েটি বলেছে, ‘সেখানে তারা আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।...চতুর্থ ব্যক্তিটি যখন ছোট বোনটিকে ধর্ষণ করে, তখন বোনটি রক্তাক্ত হয়ে মারা যায়।’ ঢাকার একটি নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রে আশ্রয় পাওয়া মেয়েটি আরও বলে, ‘আমি চেয়েছিলাম আমারও যেন মৃত্যু হয়।’

$ads={2}

এভাবে অসংখ্য বাঙালি তরুণী মারা গেছেন। এসব তরুণী গত বছর মার্চ থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে হাজার হাজার পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের দ্বারা যথেচ্ছভাবে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। অধিকৃত অঞ্চলের প্রধান টিক্কা খান তাঁর সৈন্যদের পক্ষে সাফাই গেয়ে বলতেন, ‘এখানে এখন যুদ্ধ চলছে। আর আমার সৈন্যরা পশ্চিমাঞ্চলে ফেরার আগে তাদের যৌন লালসা পূর্ণ করবে। বাঙালিরা যদি আমাদের কথায় না চলে, তবে এই প্রদেশটি আমরা ভিখারি ও বেশ্যাদের দেশে পরিণত করব।’


আরো পড়ুন - ‘প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত গড়ানো বিষয়ে আলোচনার প্রয়োজন ছিল না’, তামিমকে নিয়ে মাশরাফি


টিক্কার উত্তরসূরি জেনারেল নিয়াজি বিভিন্ন কূটনৈতিক অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানে নিজেই এসব গল্প বলতে পছন্দ করতেন। পরে একজন সাজাপ্রাপ্ত অ্যাডজুট্যান্ট এই তথ্য প্রকাশ করে বলেছিলেন, তিনি (নিয়াজি) এতটাই স্টুপিড ছিলেন যে তিনি তাঁর সহকারী অ্যাডজুট্যান্টদের জন্য ছাত্রী ও শিক্ষিত বাঙালি নারীদের সংগ্রহ করে দিতেন।

$ads={2}

দখলদার বাহিনী শুধু বিমানবন্দর–সংলগ্ন রাস্তায় চার হাজারের বেশি নারীকে ধরে নিয়ে এসে একটি বিনোদন কেন্দ্র করেছিল। লায়ালপুরের কালো বর্ণের একজন বেসামরিক পুরুষ, যার গায়ের বর্ণের কারণে তার দেশের কোনো নারী কাছে আসতে চাইত না, সে বলেছিল, ‘এই বিনোদন কেন্দ্রে আমি আমার খুশিমতো যত ইচ্ছা মেয়েকে সম্ভোগ করতে পারি। ক্যাপ্টেন এজাজ ক্যান্টনমেন্টে ছয়জন তরুণী নিয়ে একটি ব্যক্তিগত হেরেমখানা তৈরি করেছিলেন। তিনি নিজেই তাঁদের চুল কেটে দেন এবং তাঁদের সমস্ত পরিধেয় নিয়ে নেন, যাতে শাড়ি বা চুলের বিনুনি দিয়ে তাঁরা শ্বাসরোধে আত্মহত্যা করতে না পারেন।’



বালুচ রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন খালিদ ১২ বছরের রাজিয়াকে চার মাস ধরে সরকারি বাসভবনে নগ্ন হয়ে থাকতে বাধ্য করেছিলেন। তারপর তিনি রাজিয়াকে একদিন তার পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে ছুটি দিয়েছিলেন। রাজিয়া যাওয়ার সময় ক্যাপ্টেন খালিদ বলেন, সন্ধ্যার মধ্যে না ফিরে এলে তার পুরো পরিবারকে হত্যা করা হবে।



হাজার হাজার নারী ধর্ষণ থেকে রক্ষা পেতে এবং লজ্জা ও সম্ভ্রম এড়াতে আত্মহত্যা করেছেন। অনেকে সৈন্যদের দ্বারা নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতিত হয়েছেন। ডিসেম্বর মাসে যখন ভারতীয় সেনারা পাকিস্তানি সেনাদের ঘাঁটিগুলো দখলে নেয়, তখন তারা কুমিল্লা, যশোর এবং হিলির বাংকারগুলোতে উলঙ্গ যুবতী মেয়েদের মৃতদেহ দেখতে পায়। ভারতীয় বাহিনী ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দর এলাকা পরিষ্কার করার সময় একটি ধসে পড়া বাংকারে নারীদের অর্ধপচা মৃতদেহ খুঁজে পায়।

$ads={1}

মৃতদের চেয়ে বেঁচে থাকা নারীদের অবস্থা বেশি শোচনীয় ছিল। প্রায় দুই লাখ বাঙালি নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, যাঁদের অধিকাংশই এখন গর্ভবতী। দেশটি হানাদারমুক্ত হওয়ার পরও কয়েক শ নারী আত্মহত্যা করেছেন। শুধু কুমিল্লাতেই বছরের শুরু থেকে দুই শ নারী আত্মহত্যা করেছেন। কারণ, গর্ভবতী এসব নারী তাঁদের নিজেদের পরিবার থেকেই পরিত্যক্ত হয়েছেন এবং তাঁরা তাঁদের গ্রামে মুখ দেখাতে চান না।


দখলদারত্বের শেষ কয়েক মাসে যে কয়েক হাজার নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন, শুধু তাঁরাই সময়মতো গর্ভপাত করাতে সক্ষম হয়েছেন। আইনের দ্বারা যদিও গর্ভপাত বিষয়টি নিষিদ্ধ, তবু এ অবস্থায় ১০টি হাসপাতালে সরকারি সহযোগিতায় গর্ভপাত করানো হচ্ছে। এ বিষয়ে সহযোগিতার জন্য এ সপ্তাহেই ১০ জন আমেরিকান চিকিৎসক এসে পৌঁছাবেন।


বাংলাদেশ অবজারভার পত্রিকার সম্পাদক আবদুস সালাম তাঁর দেশের নাগরিকদের সমালোচনা করে বলেছেন, অত্যাচারের শিকার এই মেয়েরা মারা যাওয়ার মতোই বেঁচে আছেন, তাই সবার উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন। ৯৩ ইস্কাটন রোডে ধর্ষণের শিকার নারীদের জন্য স্থাপিত পুনর্বাসন কেন্দ্রের উদ্যোক্তা বেগম সায়েরা আহমেদ জানান, এই মেয়েরা যুদ্ধের শিকার। অথচ তাঁদের পাশে মাত্র অল্প কয়েকজন মানুষ দাঁড়িয়েছেন। ১৫০ জন মেয়ের জন্য তাঁর এই কেন্দ্র সরকারিভাবে তিন লাখ টাকা অনুমোদন পেয়েছে।


বেগম সায়েরা বলেন, ‘পাকিস্তানিদের ধর্ষণের ফলে জন্ম নেওয়া শিশুদের ভবিষ্যৎ নিয়ে এসব মেয়ে চিন্তিত। তাই জন্মের সঙ্গেই সঙ্গেই আমরা তাদের দত্তক নেওয়ার জন্য প্রস্তাব করতে চাই। যদি সম্ভব হয় ইউরোপে বা অবশ্যই দেশের বাইরে। কারণ, এই অনাগত শিশুরা দেখতে বাঙালি শিশুদের তুলনায় একেবারে আলাদা হবে। আর এই মেয়েদের আগামী দিনে নার্স বা ধাত্রী হিসেবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।’


$ads={1}

দেশপ্রেমিক হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে এই নিগৃহীত মেয়েদের বিয়ে করার জন্য স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিবাহিনী সদস্যদের অনুরোধ করা হলেও এ বিষয়ে কম সাড়া পাওয়া গেছে। তবে সবাই এ বিষয়ে একমত যে নির্যাতনের শিকার এই মেয়েদের পুনর্বাসন প্রয়োজন। বেগম সায়েরা আহমেদ প্রস্তাব করেছেন, এসব সভ্রমহারা মেয়েদের সম্মান জানানোর জন্য বীরাঙ্গনা নামে সম্বোধন করা উচিত। তবে প্রস্তাবটি স্বীকৃত হয়নি।


ওয়ার্ল্ড কাউন্সিল অব চার্চ এবং ক্যারিতাসের মতো চার্চ সংগঠনগুলো এই অসহায় মেয়েদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছে। তবে কাজটি কতটুকু পরিচালিত হবে, তা এখনই বলা যাবে না। এভাবেই শেষ হয়েছে ডের স্পিগেলের প্রতিবেদনটি।


৫০ বছর আগে বিশ্বরাজনীতি ছিল দুই বলয়ে বিভক্ত। জার্মানিসহ বিশ্বের দেশসমূহের সমাজ ও রাজনীতিকে বিভক্ত করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। বিভক্ত বলয়ের রাজনীতি একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপরও ছাপ ফেলেছিল। পশ্চিম ইউরোপীয় দেশের সরকার ও তাদের গণমাধ্যমগুলো তখন বাংলাদেশকে নিয়ে তাচ্ছিল্য ও উপেক্ষার সঙ্গে খবর প্রকাশ করত। বেশির ভাগ পত্রপত্রিকা পুঁজিবাদী বা মার্কিন বলয়ের স্বার্থ দেখত। এই স্বার্থের তল্পিবাহকেরা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধকে অভ্যন্তরীণ গৃহযুদ্ধ বলে মনে করত। পাকিস্তানি সৈন্যদের অত্যাচার–নির্যাতন, লাখ লাখ মানষকে হত্যা ও নারী নির্যাতনের বিষয়ে সরকারগুলো নিশ্চুপ ছিল। জার্মানির সংবাদপত্রও ছিল সেই কাতারে। বাংলাদেশ নিয়ে জার্মানির পত্রপত্রিকার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল নেতিবাচক। কিন্তু স্পিগেলের প্রতিবেদনটি ছিল ব্যতিক্রমী ও মানবিক।


একাত্তরে ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশে প্রায় তিন লাখ নারী হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে পৈশাচিকভাবে নির্যাতিত হয়েছিলেন। সেই নির্যাতন নিয়ে সমাজকর্মী মালেকা খান বলেছেন, ‘দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমরা বঙ্গবন্ধুর কাছে দুটি দাবি নিয়ে গেলাম। একটি হলো আন্তদেশীয় দত্তক আইন। আরেকটি হলো গর্ভপাত আইন। যাতে মেয়েদের বাঁচানো যায়। কারণ, চিকিৎসকেরা নিজে দায়িত্ব নিয়ে এগুলো করতে চাননি। এরপর অনেককে বাঁচানো সম্ভব হলো।’


বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় মহিলা পুনর্বাসন সংস্থা গড়ে উঠেছিল মুক্তিযুদ্ধের পরপরই। ১৯৭২ সালের ৭ জানুয়ারি কবি সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে তখনকার সাংসদ বেগম বদরুন্নেসা আহমেদের সহযোগিতায় গড়ে ওঠে এই সংস্থা। সরকারের সমাজকল্যাণ, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয় এ কাজে সহযোগিতা করবে—এ রকম সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরের পরিচালক বজলুল মজিদ তাঁর কর্মী বাহিনীকেও যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্তদের কাজে নিয়োজিত করেন। সুফিয়া কামালকে সভাপতি করে সংস্থার ১২ সদস্যের একটি কমিটি করা হয়।

সংস্থা কী কাজ করবে, ‘সেটাই ছিল মূল ভাবনার জায়গা। বর্বর পাকিস্তানিদের হাতে নির্যাতিত ও ক্ষতিগ্রস্ত নারী–শিশুদের উদ্ধার করা, তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, অবাঞ্ছিত মাতৃত্বের হাত থেকে হতভাগ্য নারীদের রক্ষা করা, নির্যাতিত নারীদের যুদ্ধশিশুদের দেশে–বিদেশে দত্তক দেওয়া।’ 


সরাফ আহমেদ: সাংবাদিক ও লেখক।

$ads={2}

Post a Comment

Previous Post Next Post